কক্সবাজার প্রতিনিধি: টেকনাফে রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশের পেছনে দুই এনজিওর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এগুলো হল- কানাডাভিত্তিক সংগঠন এডরা এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান আল মারকাজুল ইসলাম। সার্বিক আয়োজনে কাজ করেছে রোহিঙ্গাভিত্তিক তিনটি সংগঠন ও বিভিন্ন পেশার ৭ ব্যক্তি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এনজিও ব্যুরোতে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে দুই এনজিওর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে ব্যুরো।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে দেশ ছাড়ার ২ বছর উপলক্ষে ২৫ আগস্ট উখিয়ায় লক্ষাধিক লোক নিয়ে সমাবেশ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সমাবেশের লোক সংখ্যা দেখে বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। ঘটনার নেপথ্যে এনজিওদের সন্দেহ করা হয়।
পরে বিষয়টি তদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ইতিমধ্যে তাদের তদন্ত রিপোর্ট সরকারের হাতে এসেছে। এর আগে জড়িতদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে, এ সংক্রান্ত হুশিয়ারি দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম আবদুস সালাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবেদন পেয়েছি। ইতিমধ্যে দুটি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। তাদের শোকজ (কারণ দর্শানোর নোটিশ) করা হয়েছে। এ শোকজের জবাব এলে আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সমাবেশের জন্য বেশ কয়েকদিন আগে প্রস্তুতি নেয়া হয়। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে অ্যাডভেন্টিস্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিলিফ এজেন্সি (এডরা)।
১৯ ও ২১ আগস্ট দু’দফা বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে এ টাকা দেয়া হয়। এডরার মূল ডোনার কানাডা। এছাড়াও অংশীদার হিসেবে রয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সুইডেন। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার বিভিন্ন তহবিল নিয়েও কাজ করেছে তারা।
তবে সমাবেশে টাকার দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে তারা। এ ব্যাপারে সরাসরি বক্তব্য জানা যায়নি। তবে এডরার ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, তারা কোনো ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জড়িত নয়। যে কারণে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে, তা সত্য নয়।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে ১৯৮১ সাল থেকে তারা বাংলাদেশে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে শিক্ষা, স্থিতিস্থাপকতা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন এবং জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। মূলত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় তাদের কার্যক্রম বেশি।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের সমাবেশে টি-শার্ট ও ব্যানার তৈরি করে দেয় আল মারকাজুল ইসলাম। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে পুলিশের সহকারী পরিদর্শক (এসআই) বোরহান উদ্দিন। ব্যানার ছাপানো এবং টি-শার্টে সিল মারা হয়েছে কক্সবাজার শাহ মজিদিয়া প্রিন্টিং প্রেস থেকে।
তবে ব্যানারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শাহ মজিদিয়ার স্বত্বাধিকারী নুরুল হক। আল মারকাজুল ইসলামের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি দেশে নিবন্ধিত। শিক্ষা নিয়ে রোহিঙ্গা এলাকায় মক্তব প্রতিষ্ঠায় বেশ কিছু কাজ করেছে তারা।
সাধারণত জাকাত, ফেতরা ও সদকার মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে এ সংগঠন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন এ পর্যন্ত ৬টা এনজিওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। এদের কার্যক্রম যাতে কক্সবাজারে আর না চলতে পারে এনজিও ব্যুরোর নির্দেশে সেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সরকারের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে সমাবেশের ঘটনায় তিনটি সংগঠন ও ৭ ব্যক্তি জড়িত। সংগঠনগুলো হল- আরকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ), রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি এবং ভয়েস অব রোহিঙ্গা।
যে সব ব্যক্তি জড়িত এর মধ্যে রয়েছে- এআরএসপিএইচের প্রেসিডেন্ট মুহিবুল্লাহ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাস্টার আবদুর রহিম, রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির নেতা সিরাজুল মোস্তফা এবং ভয়েস অব রোহিঙ্গা নেতা সাইফুল হক, উখিয়া কলেজের প্রভাষক নুরুল মজিদ ভুইয়া, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী দুলাল মল্লিক এবং কক্সবাজারের দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান। তবে এ ঘটনায় এ পর্যন্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারসহ উখিয়া ও টেকনাফ শিবিরে দায়িত্বরত ৭ জন ক্যাম্প ইনচার্জকে বদলি করা হয়।
এনজিও বিষয়ক ব্যুরো সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নিয়ে ১৮৯টি এনজিও কাজ করছে। এসব এনজিও বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২১টি প্রকল্পে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা বিদেশি সহায়তা নিয়েছে।
এর মধ্যে দেশের ১৩৪টি এনজিওর বিপরীতে ছাড় হয়েছে ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বিদেশি ৫৫টি এনজিওর প্রকল্পে ছাড় হয়েছে ১ হাজার ৪৬৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে।
এ খাতে এ পর্যন্ত ব্যয় ২৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া খাদ্য খাতে ১৭৮ কোটি এবং বস্ত্র খাতে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়াও এনজিওগুলোর মাধ্যমে ১৬ হাজার টয়লেট এবং ২২ হাজার টিউবওয়েলসহ স্যানিটেশনের বেশ উপকরণ দেয়া হয়েছে।
তবে রোহিঙ্গা এলাকায় এ পর্যন্ত ৬টি এনজিও তহবিল ছাড় বন্ধ রেখেছে এনজিও ব্যুরো।
এগুলো হল- মুসলিম এইড ইউকে, ইসলামিক রিলিফ, ইসলামিক এইড, স্মল কাইন্ডনেস বিডি, নমিজন আফতাবি ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি। দাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকেন্দ্রিক।
এছাড়া আরব দেশগুলো থেকেও এনজিওদের কিছু সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে বিদেশি সহায়তার বড় অংশই সরকারিভাবে আসে। এনজিওদের মাধ্যমে যে সহায়তা আসে, সেটিও সরকারের নজরদারির মধ্যে ব্যয় হয়।
এনজিও ব্যুরো ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ৪১টি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করে সরকার।
এদিকে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়হীনতার কারণেই এ ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের নাগরিকদের সংগঠন আমরা কক্সবাজারবাসীর সমন্বয়ক কলিম উল্লাহ বলেন, উখিয়া টেকনাফের যে জনসংখ্যা তার চেয়ে বেশি লোক নিয়ে তারা সমাবেশ করেছে। ফলে এখানে যে কোনো সময়, যে কোনো কিছু হতে পারে, এজন্য আমরা খুবই আতঙ্কে আছি।